
লেখা : মির্জা ফারিহা ইয়াসমিন
বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে কিছু দিন আছে, যেগুলো কেবল ইতিহাস নয় অন্তরের গভীর শোকের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস তেমনই এক দিন। একটি জাতিকে মস্তিষ্কশূন্য করে দেওয়ার নৃশংস পরিকল্পনার ভয়াবহ সাক্ষী এই তারিখ। তবে হত্যাযজ্ঞ শুধু এই দিনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের আগে, যুদ্ধ চলাকালীন এবং এমনকি স্বাধীনতার পরও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শিক্ষিত, সৃজনশীল ও মুক্তচিন্তার অধিকারী মানুষদের পদ্ধতিগতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ পাকিস্তান জানত, একটি জাতির শক্তি তার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই নিহিত। তাই তাদের লক্ষ্য ছিল—রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব, চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতা ধ্বংস করে দেওয়া। ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাযজ্ঞ তাই নিছক নৃশংসতা নয় এটি ছিল এক কৌশলগত গণহত্যা।
বাংলাদেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ইতিহাসে উজ্জ্বল নাম প্রফেসর সৈয়দ মুহাম্মদ শামসুজ্জোহা।১৯৬৯ সালের উত্তাল ছাত্রআন্দোলনে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাম্পাসে গুলি চালাতে উদ্যত হয়, তখন তিনি শিক্ষার্থীদের রক্ষায় নিজের জীবনকে ঢাল করেছিলেন। ক্যাম্পাসের মাটিতে তাঁর রক্ত ঝরেছিল গণঅধিকার আন্দোলনের প্রথম চেতনার প্রতীক হয়ে। আজও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাতাসে তাঁর সাহসিকতার গল্প ভাসে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় অনিবার্য দেখে বুঝেছিল যুদ্ধের ময়দানে না জিতলে জাতির সম্ভাবনাকেই ধ্বংস করে দিতে হবে। সেই পরিকল্পনার সর্বশেষ ও ভয়াবহ রূপ হলো ১৪ ডিসেম্বর।
ভোর হতে না হতেই আলবদর বাহিনী হাতে নেয় পূর্বনির্ধারিত “হিট লিস্ট”। দেশের সেরা শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, গবেষক যারা একটি জাতিকে নেতৃত্ব দিতে পারতেন, তাদের একে একে তুলে নিয়ে যায়।
বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রপথিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি জানানো এই মহৎ মানুষকে আটক করে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী প্রতিশোধ নিয়েছিল সেই ভাষার, যা এ দেশের মানুষের পরিচয়।
যে সাংবাদিক কলম দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়েছিলেন, তালিকা প্রকাশে বাধা দিয়েছিলেন তাকে হত্যা করতেই আলবদর বাহিনীর এ রকম অস্থিরতা।১৪ ডিসেম্বর বাসা থেকে অপহরণের পর নির্যাতিত দেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। এক নারী, এক মা, এক সাংবাদিক যিনি সত্যের পক্ষে ছিলেন, সেই সত্যই শেষ পর্যন্ত তাঁর পরিচয় হয়ে রইল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, যিনি ভাষা আন্দোলন থেকে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ আন্দোলন পর্যন্ত ছিলেন সক্রিয়। তাঁকে তুলে নিয়ে একই দিনের ভোরে হত্যা করা হয় রায়েরবাজারে। যারা ইতিহাসের আলো জ্বালান তাদেরই নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল।বাংলা চলচ্চিত্রের অগ্রদূত জহির রায়হান যিনি ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ও ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর মতো মহত্তম কাজের স্রষ্টা নিজের নিখোঁজ ভাইকে খুঁজতে গিয়ে মিরপুরে সশস্ত্র ঘাতকদের হাতে নিহত হন বলে ধারণা করা হয়। তার দেহ আজও অনাবিষ্কৃত যেন এক জাতির শোককে স্থায়ী করে রাখার প্রতীক।
স্বাধীনতার পর আরও এক সম্ভাবনাময় কবি হুমায়ুন কবির হত্যার শিকার হন ১৯৭২ সালে।মাত্র আট বছরের সাহিত্যজীবনে যে অসাধারণ সম্ভাবনা ফুটে উঠেছিল, তা চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায় রাজনৈতিক সন্ত্রাসের গুলিতে।
রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমি আজও সাক্ষ্য দেয় কেমন বিকৃত, ক্ষতবিক্ষত, অমানুষিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। দাঁত ভাঙা, হাত পা ভাঙা, চোখ উপড়ে নেওয়া, বেয়নেটের আঘাত, গুলিবিদ্ধ ক্ষত এই সবই প্রমাণ করে এ ছিল এক গণহত্যা, যার লক্ষ্য ছিল জাতির ভবিষ্যৎ।
আমরা জানি না, কত প্রতিভা, কত স্বপ্ন, কত অনাবিষ্কৃত সম্ভাবনা সেই মাটির নিচে চিরতরে নিভে গেছে।
স্বাধীনতার পরে ১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দিনটি বাঙালি জাতির জন্য শোক ও শ্রদ্ধার প্রতীক, একইসঙ্গে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ইতিহাসকে বিকৃত হতে দেব না, স্বাধীনতার মূল্যবোধ রক্ষা করব এবং একটি মানবিক, মুক্তচিন্তার বাংলাদেশ গড়ে তুলব।
বাঙালি এই শোকের অতল থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, এবং আজ বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময়, অগ্রসর জাতি হিসেবে বিশ্বের সামনে রোল মডেল।


