
শীত আসলেই বাংলার গ্রামীণ জনজীবনে যেন এক অন্যরকম উচ্ছ্বাস নেমে আসে। সকালবেলার কুয়াশায় ভেজা বাতাস, দূরের পুকুরপাড়ে ধোঁয়া ওঠা পিঠার হাঁড়ি, আর সঙ্গে মাটির কলসিতে গাছ থেকে ঝরা টলটলে খেজুর রস, সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত আবেশ।কিন্তু এই রসের মিষ্টি স্বাদ আর সুবাসের আড়ালেই আছে এক ভয়ংকর বাস্তবতা, নিপাহ ভাইরাসের হুমকি।
নিপাহ ভাইরাসের নাম এখন আর অপরিচিত নয়। প্রায় প্রতিবছরই শীতকালে দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এটি এক মারাত্মক ভাইরাস, অর্থাৎ প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ছড়ায়। মূল বাহক ফলভোজী বাদুড়। রাতের বেলা বাদুড়েরা খেজুর গাছের রস খাওয়ার সময় হাঁড়ির মুখে মল-মূত্র ত্যাগ করে। আর সেই দূষিত রস যদি সরাসরি কেউ পান করে তাহলেই এই ভয়াবহ ভাইরাস শরীরে প্রবেশের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
বাংলাদেশে প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয় ২০০১ সালে। মেহেরপুর জেলায় নিপাহ ভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাব চিহ্নিত হয়। এ পর্যন্ত ৩৩৯ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২৪০ জন মারা গেছেন। এরপর রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জেলায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বহু মানুষ মারা গেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, এই ভাইরাসে মৃত্যুহার ৭০ শতাংশেরও বেশি যা করোনাভাইরাসের তুলনায় বহুগুণ প্রাণঘাতী।
ভাইরাসটির উপসর্গও ভয়াবহ। শুরু হয় সাধারণ জ্বর, মাথাব্যথা, ক্লান্তি দিয়ে। দ্রুত তা রূপ নেয় খিঁচুনি, অজ্ঞান হওয়া, এমনকি কোমায় চলে যাওয়ার মতো জটিল অবস্থায়। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা, এটি মানুষ থেকে মানুষেও ছড়ায়। অর্থাৎ, আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকা পরিবারের সদস্য বা স্বাস্থ্যকর্মীরাও বিপদে পড়তে পারেন।
আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে খেজুর রসের স্থান বিশেষ। গাছিরা মাসের পর মাস পরিশ্রম করে আমাদের জন্য তুলে আনেন সেই স্বচ্ছ সোনালি রস। এই রস দিয়ে তৈরি হয় গুড়, পাটালি, চিনি, যা দেশের হাজারো মানুষের জীবিকার সঙ্গে জড়িত। তাই নিপাহ ভাইরাসের ভয় দেখিয়ে এই ঐতিহ্যকে বন্ধ করে দেওয়া সমাধান নয়, বরং দরকার সচেতনতা ও নিরাপদ পদ্ধতির ব্যবহার।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রসের হাঁড়ির মুখ ‘চাট’ (বাঁশপাতা বা মাটির ঢাকনা) লাগালে বাদুড়ের প্রবেশ রোধ করা যায়। তাছাড়া সরাসরি কাঁচা রস পান না করে সিদ্ধ বা গুড় হিসেবে খেলে এটির ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সরকারি পর্যায়ে রস সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিক্রির ক্ষেত্রে নিয়মিত স্বাস্থ্য তদারকি থাকলে এ ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
আমরা প্রায়ই শুনি “একটু অসচেতনতাই বড় বিপদ ডেকে আনে।” নিপাহ ভাইরাসের ক্ষেত্রেও কথাটা একেবারেই সত্য। শীতের সকাল, খেজুর রসের গন্ধ, ভাপা পিঠার ধোঁয়া- এসব কিছুই হারাতে হবে না, যদি আমরা একটু সতর্ক হই। আমাদের হাতে আছে দুটি পথ – একদিকে মিষ্টি ঐতিহ্য, অন্যদিকে অবহেলাজনিত মৃত্যু। বেছে নিতে হবে সচেতনতার পথ। কারণ, জীবন যদি থাকে, তবেই তো রসের স্বাদ মেলে।


