মতামত

৫৪ বছরের বিজয়: স্বাধীনতা পেয়েছি, মুক্তি কি সম্পূর্ণ?

122views

লেখা : বুশরা আজমী

ডিসেম্বর এলেই বাংলাদেশের আকাশে শুধু বিজয়ের পতাকা নয়, ভেসে আসে প্রশ্নও। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর—রক্ত, ত্যাগ আর অসীম স্বপ্নের বিনিময়ে অর্জিত সেই বিজয় আজ ৫৪ বছরে পা দিল। একটি মানচিত্র পেয়েছিলাম, একটি পতাকা পেয়েছিলাম, পেয়েছিলাম নিজের পরিচয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—এই দীর্ঘ পথচলায় আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে পেরেছি? নাকি স্বাধীনতার সংজ্ঞা এখনও অসম্পূর্ণ?

স্বাধীনতার প্রথম অর্থ ছিল শৃঙ্খল ভাঙা। পাকিস্তানি শাসন, ভাষা দমন, রাজনৈতিক বঞ্চনা আর অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা রাষ্ট্র পেয়েছি। সেই রাষ্ট্র আজ বিশ্ব মানচিত্রে দৃশ্যমান, কূটনীতিতে সক্রিয়, উন্নয়নের সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে—এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রগতি, ডিজিটাল সেবা—সবই উন্নয়নের গল্প বলে। কিন্তু উন্নয়নের আলো যত উজ্জ্বল, ছায়াগুলোও তত স্পষ্ট।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় সেই চেতনার সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের দূরত্ব বাড়ছে কি না—এই প্রশ্ন অনিবার্য। স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়েও মানুষ নিরাপত্তাহীন বোধ করে, ন্যায়বিচারের আশায় বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরে বেড়ায়, চাকরি ও সুযোগের প্রশ্নে যোগ্যতার চেয়ে পরিচয় বড় হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা কেবল রাষ্ট্রের হলে চলে না, নাগরিকের জীবনেও তার প্রতিফলন চাই।

বর্তমান দেশের পরিস্থিতি আমাদের সামনে দ্বিমুখী বাস্তবতা হাজির করে। একদিকে উন্নয়নের পরিসংখ্যান, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের চাপ, আয়–ব্যয়ের অসামঞ্জস্য, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা। তরুণরা শিক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু কাজের বাজার সংকুচিত। স্বপ্ন বড় হচ্ছে, বাস্তবতা ছোট হয়ে আসছে। এই তরুণরাই তো ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা—তাদের হতাশা কি আমাদের মুক্তির অসম্পূর্ণতার ইঙ্গিত দেয় না?

মুক্তি মানে কেবল বিদেশি শাসনের অবসান নয়; মুক্তি মানে ভয়মুক্ত জীবন। মত প্রকাশে সংকোচ, ভিন্নমতকে সন্দেহের চোখে দেখা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বাস্তব জীবন—সবখানেই অদৃশ্য সীমারেখা। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে নাগরিকের কণ্ঠ যদি চাপা পড়ে, তবে বিজয়ের অর্থ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনেই সীমাবদ্ধ নয়; গণতন্ত্র হলো প্রতিদিনের অধিকার চর্চা।

দুর্নীতি আজও আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। মুক্তিযুদ্ধের সময় শত্রু ছিল দৃশ্যমান, আজ শত্রু অদৃশ্য—ব্যবস্থার ভেতরে ঢুকে পড়া অনিয়ম। যখন হাসপাতাল, শিক্ষা, প্রশাসন—সবখানে নৈতিকতার সংকট দেখা দেয়, তখন স্বাধীনতার স্বাদ তেতো হয়ে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধারা যে স্বপ্নে জীবন দিয়েছিলেন, সেখানে কি এই বাস্তবতার জায়গা ছিল?

তবুও এই দেশ হতাশার নয়। কারণ এই দেশই বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান—ইতিহাস বলে, বাঙালি কখনো নীরবে সব মেনে নেয় না। আজও সাধারণ মানুষের ভেতরে আছে প্রতিবাদের শক্তি, আছে ন্যায়বোধ, আছে ভালো রাষ্ট্র গড়ার আকাঙ্ক্ষা। বিজয় দিবস আমাদের সেই শক্তির কথাই মনে করিয়ে দেয়।

৫৪ বছরের বিজয় তাই কেবল উৎসবের নয়, আত্মজিজ্ঞাসার দিন। আমরা স্বাধীন হয়েছি—এটা সত্য। কিন্তু মুক্তি একটি চলমান প্রক্রিয়া। অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক মুক্তি, মানসিক মুক্তি—সব মিলিয়েই পূর্ণতা। রাষ্ট্র যতই এগোক, নাগরিক যদি পিছিয়ে থাকে, তবে বিজয় অপূর্ণ থেকে যায়।

এই ডিসেম্বর তাই আমাদের নতুন করে ভাবার সময়। পতাকা হাতে উল্লাসের পাশাপাশি প্রশ্ন তুলতে হবে—আমরা কোন বাংলাদেশ চাই? যে বাংলাদেশ শুধু অতীতের গৌরবে বাঁচবে, নাকি যে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রতিদিনের জীবনে বাস্তবায়ন করবে? ৫৪ বছরের বিজয় আমাদের সেই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। স্বাধীনতা পেয়েছি—এটাই শেষ কথা নয়। সত্যিকারের বিজয় তখনই, যখন প্রতিটি মানুষ বলতে পারবে—আমি স্বাধীন, আমি মুক্ত।

Leave a Response