জাতীয়

ওসমান হাদি আর নেই

29views

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখভাগের অকুতোভয় যোদ্ধা ও ‘ইনকিলাব মঞ্চ’-এর মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদি আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাত পৌনে ১০টার দিকে ইনকিলাব মঞ্চের ভেরিফায়েড পেজে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।

পেজের এক পোস্টে বলা হয়, ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের মোকাবিলায় মহান বিপ্লবী ওসমান হাদীকে আল্লাহ শহীদ হিসেবে কবুল করেছেন।’

এর আগে, গত শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুর আনুমানিক আড়াইটার দিকে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোড এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশায় থাকা অবস্থায় শরীফ ওসমান হাদিকে মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তরা গুলি করে। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয় এবং তিনি সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে উঠে এসেছে, হামলার আগের কয়েক মাস ধরে শরীফ ওসমান হাদির নিয়মিত চলাচল, বাসা ও অফিসের রুট এবং তার নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর ধারাবাহিকভাবে নজরদারি চালানো হচ্ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে করা এই প্রস্তুতির নেপথ্যে কারা জড়িত এবং কার স্বার্থে এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল—তা জানার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা।

আরও পড়ুন: হাদিকে গুলির ঘটনায় আদালতে জবানবন্দিতে যা বললেন গাড়ির মালিকহাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে অনুসন্ধান, তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষণ এবং গ্রেফতার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রের সন্ধান এবং সন্দেহভাজন মূল আসামি ফয়সালের অপরাধজগতের নেটওয়ার্কের বিস্তারিত চিত্র।

র‌্যাব ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হাদিকে গুলি করার পরপরই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান ওরফে রাহুল আগারগাঁওয়ে তার বোনের বাসায় গিয়ে ওঠেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী দুদিন পর পরিস্থিতি বুঝে পালিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সেদিনই শুটার ফয়সাল ও মোটরসাইকেল চালক আলমগীর শেখ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি, তারা এরই মধ্যে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছে।

গোয়েন্দারা আরও জানান, ফয়সালের অস্ত্র-সংক্রান্ত তথ্য জানতেন তার বাবা হুমায়ুন কবির, মা হাসি বেগম, স্ত্রী সাহেদা পারভীন সামিয়া, শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ শিপু এবং বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমা। অস্ত্রভর্তি ব্যাগটি ফয়সাল তার বাবা হুমায়ুন কবিরের জিম্মায় রেখে যান। তবে হুমায়ুন কবির বিষয়টি গোপন রাখেন।

হাদির ওপর গুলিবর্ষণকারী ফয়সালের স্ত্রী, শ্যালক ও বান্ধবীকে জিজ্ঞাসাবাদের পর অস্ত্রের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রথম দফায় মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের কর্নেল গলিতে ফয়সালের বোনের বাসার নিচ থেকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের দুটি ম্যাগাজিন ও ১১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে র‌্যাব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের আশঙ্কায় এগুলো বাসা থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। গ্রেফতারকৃতদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব ফয়সালের বাবা-মা ও আরেক সহযোগী কবিরকে গ্রেফতার করে। পরে ফয়সালের বাবা-মা ও সহযোগীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ওইদিনই নরসিংদী থেকে আরও পাঁচটি অস্ত্র এবং ৪১ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী জানান, শরীফ ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদ নরসিংদী সদর থানার তরুয়া এলাকার মোল্লাবাড়ির সামনের তরুয়া বিলের পানির মধ্য থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

র‌্যাবের গোয়েন্দা সূত্র জানায়, অভিযুক্তদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে এমন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, যেখানে আরও কয়েকজন ব্যক্তির নাম, অবস্থান ও চলাচলের তথ্য রয়েছে। এসব তথ্য এখনও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় ডিএমপির পল্টন থানায় হত্যাচেষ্টা মামলা করেন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের। মামলাটির তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। এ বিষয়ে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “গ্রেফতার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। হাদির ওপর গুলিবর্ষণে কার কী ভূমিকা ছিল এবং নেপথ্যে কারা জড়িত—সব দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

এ পর্যন্ত র‌্যাব ও পুলিশ যৌথভাবে এই ঘটনায় ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে। তারা হলেন— ফয়সালের স্ত্রী সাহেদা পারভীন সামিয়া, শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ শিপু, বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমা, হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক আবদুল হান্নান, সীমান্ত এলাকায় মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে সঞ্জয় চিসিম ও সিবিরন দিও, ফয়সালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও মোটরসাইকেলের মূল মালিক মো. কবির এবং ফয়সালের বাবা হুমায়ুন কবির ও মা মোসাম্মৎ হাসি বেগম। এদের মধ্যে আবদুল হান্নানকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে রবিবার (১৪ ডিসেম্বর) তিন দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) ফয়সালের স্ত্রী, শ্যালক ও বান্ধবীকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এছাড়া কবিরকে সাত দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে।

Leave a Response