মতামত

মেধা কোষ র্নিমূল করার ষড়যন্ত্র : শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ

75views

স্বপ্ন দেখার অপরাধের বিরুদ্ধে ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম নীলনকশা

১৪ ডিসেম্বরের ভোরবেলা। ঠান্ডা বাতাসে কুয়াশা জমে আছে। ঘুমের ভেতর টানা ধাক্কার শব্দ, একটা পরিবার যেটা কখনও ভুলতে পারেনি। দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে কিছু সশস্ত্র মুখোশধারী মানুষ। তারা কারো পরিচয় জানতে চায়নি, কেউ জানতেও চায়নি তিনি কী করেন, সমাজে তাঁর ভূমিকা কী। শুধু চোখ বেঁধে হাতে দড়ি বেঁধে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো অচেনা অন্ধকারে।সেই অন্ধকার রাতই ছিল বাংলাদেশ থেকে আলো চুরি করার রাত।প্রশ্ন একটাই, এই মানুষগুলোর অপরাধ কী ছিল?

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের “অপরাধ” ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন মাথায় রাখা। তাঁরা চেয়েছিলেন এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে মানুষ হবে সমান, সমাজ হবে অসাম্প্রদায়িক, শিক্ষা ও সংস্কৃতি হবে শক্তির ভিত্তি, সত্য ও মানবতা থাকবে প্রতিটি সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে।এরা যুদ্ধক্ষেত্রে বন্দুক ধরেননি ঠিকই, কিন্তু তাঁরা অন্য এক ভয়ংকর যুদ্ধ লড়ছিলেন, চেতনার যুদ্ধ।তাঁরা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক শক্তি, মানুষের মননে স্বাধীনতার বীজ বপন করা একদল স্বপ্নবান মানুষ। এক কথায় তাঁরা ছিলেন দেশের অগ্রযাত্রার আলো। আলোই যে অন্ধকারের সবচেয়ে বড় শত্রু আর এই আঁধারের মধ্যেই বিলীন হয়েছিল বাংলার জ্ঞানকোষ।

১৯৭১ সালের শেষ প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুঝে গিয়েছিল যে সামরিক পরাজয় অনিবার্য। যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ়তায় তারা ভেঙে পড়ছিল। কিন্তু একটি জাতিকে সম্পূর্ণভাবে অক্ষম করার আরও নিষ্ঠুর উপায় ছিল তার মেধাশক্তিকে ধ্বংস করে দেওয়া। লক্ষ্য ছিল স্পষ্টস্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম নিলেও যাতে সে দাঁড়াতে না পারে, প্রজ্ঞাশক্তিহীন হয়ে পড়ে, নেতৃত্বহীন থাকে।এ কারণে পাকিস্তান বাহিনী আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকার বাহিনীকে দিয়ে শুরু করল ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য অপারেশন, পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী নিধন।

একজন শিক্ষক ভাবনার স্বাধীনতা শেখান, একজন সাংবাদিক সত্যের পক্ষে দাঁড়ান, একজন লেখক সমাজের অন্ধকার তুলে ধরেন, একজন চিকিৎসক মানবতার সেবা করেন। এই মানুষগুলোকে হত্যা মানে, একটি জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া।কারণ, চিন্তা যেখানে বন্দী, স্বাধীনতাও সেখানে বন্দী।

একজন মুনীর চৌধুরীর লেখনী,একজন ড. আলীম চৌধুরীর সেবা, একজন আনোয়ার পাশার সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা- এগুলোই ছিল পাকিস্তান বাহিনীর কাছে হুমকি। তারা জানত, এসব মানুষ বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ শুধু মুক্তই হবে না, হবে অগ্রসর, যুক্তিবাদী ও আধুনিক রাষ্ট্র। আর সেই ভবিষ্যৎ ঠেকানোর একমাত্র উপায় এই মানুষগুলোকেই হত্যা করা।

১৪ ডিসেম্বর ভোর থেকে ঢাকা শহর অদ্ভুত নিস্তব্ধ। একের পর এক বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয় দেশের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোকে। মোহাম্মদপুরের জঙ্গলবাড়ি, মিরপুরের বধ্যভূমি, রায়েরবাজারের পরিত্যক্ত ইটভাটা, এই সব স্থান আজও বুক চিরে ওঠে সেই বিভৎস স্মৃতিতে।হাত বাঁধা, চোখ বাঁধা, নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত লাশ। স্বাধীনতার ঠিক দু’দিন আগে এ যেন আলোকে হত্যা করার আয়োজন। বিজয়ের আনন্দ যখন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন শত শত পরিবার খুঁজে বেড়াচ্ছিল তাদের প্রিয়জনের নিথর দেহ।স্বাধীনতার প্রথম উল্লাসে যাদের কান্না মিশে ছিল, তারা ছিল শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবার।

এক মুহূর্ত কল্পনা করুন, যদি তারা বেঁচে থাকতেন, আজকের বাংলাদেশ কতটা অগ্রসর হতে পারত? দেশের শিক্ষা, চিকিৎসা, গণমাধ্যম, গবেষণা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সবই হতো আরও শক্তিশালী, আরও মানবিক, আরও প্রগতিশীল। কতটা সমৃদ্ধ হতো আমাদের সোনার বাংলা।

অনেক গণহত্যা পৃথিবীতে হয়েছে, কিন্তু এমন নির্মমভাবে কোনো জাতির শ্রেষ্ঠ মানুষদের বেছে বেছে হত্যার পরিকল্পনা খুবই কম। কারণ এটি ছিল একটি জাতিকে মেরুদণ্ডহীন করার পরিকল্পনা, আর তা বাস্তবায়নও হয়।১৪ ডিসেম্বর মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক ভয়ংকর কালো দিন।

তাহলে তাঁদের অপরাধ কী ছিল? তাঁরা স্বাধীনতার, ন্যায়ের, মানবতার, আলোর পক্ষে ছিলেন। হ্যাঁ, তাদের হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের স্বপ্নকে হত্যা করা যায়নি।তাঁদের জ্ঞানের আলো নিভিয়ে দেওয়া যায়নি। দেশ স্বাধীন হয়েছে, মানুষ স্বাধীন হয়েছে,স্বাধীন হয়েছে দেশের প্রতিটি জনগণের চিন্তাশক্তি, এটাই তাঁদের সবচেয়ে বড় জয়।

অন্ধকার যত গভীরই হোক, আলো কখনো হারায় না। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তেই জন্ম নিয়েছে আলোর এই বাংলাদেশ। যে আলোয় আলোকিত হচ্ছে একাত্তরের বিধ্বস্ত বাংলাদেশ।

Leave a Response

সুশ্রী সরকার

সুশ্রী সরকার

কন্ট্রিবিউটর
দৈনিক ইত্তেফাক-এ লেখালেখির মধ্য দিয়ে আমার লেখকসত্তার যাত্রা শুরু হয় ২০২৫ সালের ৯ ডিসেম্বর। বর্তমানে আমি ইনসাইড বাংলা-তে কন্ট্রিবিউটর হিসেবে নিয়মিত লিখছি। আমার জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে। বেড়ে উঠেছি কবি জীবনানন্দ দাশের স্মৃতিবাহী বনলতা সেনের শহর নাটোরে। বর্তমানে আমি রাজশাহী কলেজের সমাজকর্ম বিভাগে অধ্যয়নরত। সমাজ, মানুষ ও সময়ের নানামাত্রিক গল্প তুলে ধরাই আমার লেখালেখির প্রধান আগ্রহ ও অনুপ্রেরণা!